
পরিত্রাণায় সাধুনাম্ বিনাশায়চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
উনি আসবেন যুগে যুগে। কিন্তু এসে কী করবেন? সাধুদের পরিত্রাণ করবেন এবং দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করবেন। নিশ্চই ভাবছেন, তাহলে তো উনি আমাদের রক্ষা করার জন্য লড়াই করবেন। আমরা তাঁর ভক্ত। তাহলে উনি কি আমাদের রক্ষা করবেন না? কিন্তু আমরা কি ভেবেছি যে কেন উনি আমাদের রক্ষা করতে আসবেন? আমরা কি আদৌ সাধু? স্বার্থপরতা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, পরনির্ভরশীলতা, স্বাভিমানহীনতা, অন্যায়ের সাথে আপোষকামিতা, অপরাধের সামনে নীরবতা-নিষ্ক্রিয়তা, স্বজন-স্বজাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা- এই সম্বল করে আমরা নিজেদের সাধু মনে করি? আসলে আমরাই তো দুষ্কৃতী! আমাদের ভাগ্য ভালো যে ভগবান আসেন নি। উনি এলে সর্বপ্রথমে আমাদের ধ্বংস করবেন। কারণ উনি দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ করার উদ্দেশ্যেই আসবেন।
আমাদের এই বঙ্গে আমরা কম কীর্তন করেছি? অষ্টপ্রহর, চব্বিশ প্রহর কত কি করেছি? উনি কি বাঁচিয়েছেন আমাদের? কত অত্যাচার, কত অপমান আমরা সহ্য করছি প্রতিদিন! কত ভক্তকে কোতল করা হয়েছে! কত ভক্তকে ধর্ষণ করা হয়েছে! কত কৃষ্ণমন্দির ভাঙা হয়েছে! কত ভক্তের হাত থেকে শালগ্রাম শিলা কেড়ে নিয়ে সেই হাতে আসমানী কিতাব ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে! এসেছেন উনি তাদের রক্ষা করতে? আসেন নি। বরং আমি মনে করি আমাদের সাথে যা যা হয়েছে এবং হচ্ছে, তা ভগবানের ইচ্ছাতেই হচ্ছে। যারা ভগবানের নাম-কীর্তন ভাঙতে এসেছে, মন্দির ভাঙতে এসেছে, ভক্তের কাছ থেকে ভগবানকে কেড়ে নিতে এসেছে, ভক্তদের উপরে অকথ্য অত্যাচার করেছে, মুখোমুখি রুখে দাঁড়িয়ে তাদের মাথা ভেঙে দেওয়ার পরিবর্তে আমরা কাঁদতে কাঁদতে পালিয়ে এসেছি। যদি এক ভক্তের বিপদে আরেক ভক্ত না দাঁড়ায়, তবে সেই ভক্তদের প্রতি কি ভগবান প্রসন্ন হতে পারেন? তাই আমাদের আর ভগবানের নাম-কীর্তন করার অধিকার নেই। পালিয়ে এসে যতই নাম-কীর্তন করি না কেন, ভগবান সেই নাম শোনেন না কারণ কাপুরুষের মুখে কৃষ্ণনাম মানায় না। ভগবানের প্রিয় হতে হলে পরাক্রমী অর্জুন হতে হয়, সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনেও আপোষহীন অবিচল ভক্ত প্রহ্লাদ হতে হয়। আমরা ভক্তির নামে যে ভন্ডামি করে চলেছি তাতে আশীর্বাদ নয়, বরং তার শাস্তিই ভগবান আমাদের দিয়ে চলেছেন।
আর যদি আমরা সাধু হই, তাহলেও কি উনি আমাদের জন্য লড়াই করবেন? যদি তাই হয়, তাহলে কুরুক্ষেত্রের মহারণে উনি পান্ডবদের হয়ে নিজে অস্ত্রধারণ করে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেন না কেন? কেনই বা অর্জুনকে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী স্বজনবিনাশী সেই যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন? কেন অভিমন্যুকে রক্ষা করলেন না? কেন ঘটোৎকচের প্রাণ গেল? আসলে কৃষ্ণরূপে ভগবান আমাদের আমাদের যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন তা হল নিজের লড়াই সর্বদা নিজেদেরই লড়তে হয় এবং এই লড়াইয়ে হারজিতের বাজি নিজের উপরেই ধরতে হয়- হতো বা প্রাপ্স্যতি স্বর্গং, জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্। অন্যের উপরে বাজি ধরে আত্মপ্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় না। আমরা আত্মসম্মান চাই, আত্মপ্রতিষ্ঠা চাই, নিরাপত্তা চাই কিন্তু তারজন্য আমরা নিজেদের বাজি ধরতে রাজী নই, আমাদের বাজি হল পুলিশ, নেতা, রাজনৈতিক দল ইত্যাদি। কেউ আমার বাড়ি পুডিয়ে দিতে এলে পুলিশ বাঁচাবে। কেউ আমার মেয়েকে টেনে নিয়ে গেলে পুলিশ বাঁচাবে। কেউ জোর করে আমার জমি কেড়ে নিলে পুলিশ বাঁচাবে। পুলিশের অসাধ্য হলে সেনা আসবে! আমরা শুধু প্রশ্ন করবো আর অভিযোগের আঙুল তুলবো। এইভাবে সব দায়িত্ব যদি নেতা-পার্টি-পুলিশ-সেনার উপরে ঠেলে দেওয়া হয়, স্বাভাবিকভাবেই সব অধিকারও তাদেরই হাতে চলে যায়। সব দায় ওদের আর সব অধিকার আপনার- এটা হতে পারে না। আমাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের লড়াই নিজে লড়েছেন এবং কংস-শিশুপালদের নিজের হাতে বধ করেছেন। কিন্তু অর্জুনদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দাঁড়িয়ে অর্জুনদের বলেছেন মৃত্যুভয় ত্যাগ করো। এই যুদ্ধে আমি অস্ত্রধারণ করবো না। নিজেদের লড়াই তোমরা নিজেরাই লড়ো-
অজো নিত্যঃ শাশ্বতঃ অয়ং পুরোণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
অর্থাৎ, আত্মা শাশ্বত, তার জন্ম-মৃত্যু নেই। আমরা মরি না, কেবলমাত্র এই ক্ষণস্থায়ী শরীরেরই মৃত্যু হয়।
আর বলেছেন-
হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষসে মহীম্
তস্মাৎ উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়।।
অর্থাৎ, অধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে মনস্থির করো। প্রাণ গেলে স্বর্গ, জিতলে পৃথিবী।
পরিশেষে স্পষ্টভাষায় বলে গেছেন যুদ্ধজয়ের শর্ত কি-
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতিঃ ধ্রুবানীনির্মতির্মম।।
অর্থাৎ
একা কৃষ্ণে জয় নাই
সাথে ধনুর্ধারী পার্থ চাই।
আসুন নিজেদের লড়াই নিজেরাই লড়ি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশির্বাদে ধর্মের জয় হবেই।